মঙ্গলবার ২৯ এপ্রিল ২০২৫
সম্পূর্ণ খবর
Riya Patra | ২৩ এপ্রিল ২০২৫ ০১ : ১৭Riya Patra
গৌতম রায়
অখণ্ড বাংলায় হিন্দু-মুসলমানের আত্মীয়তাপূর্ণ সহাবস্থানের জীবন্ত ছবি বুকে ধারণ করে, তার স্পর্শ প্রজান্মান্তরে সঞ্চারিত করবার বোধহয় শেষ মানুষ ছিলেন শঙ্খ ঘোষ(১৯৩২, ৫ ফেব্রুয়ারী-২০২১, ২০ এপ্রিল)। কাজী আবদুল ওদুদ, অন্নদাশঙ্কর রায়, সুফিয়া কামাল, আনিসুজ্জামানদের প্রজন্মের পর অখণ্ড বাংলাকে, অখণ্ড বাঙালি জাতিসত্তাকে বুকে লালন করা বাঙালি বোধহয় খুব বেশি আর রইলেন না বাঙালির বৃহত্তর পরিমণ্ডলে। বরিশালের সন্তান তিনি পিতৃসূত্রে। জন্ম মামার বাড়ি কুমিল্লার চাঁদপুরে। বেড়ে ওঠা পাবনার পাকসিতে। পাকসি, পাবনার আনাচকানাচ, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ,যে ব্রিজকে সারা ব্রিজ বলার বোধহয় শেষ মানুষদের অন্যতম ছিলেন তিনি, জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ফেলা পর্যন্ত এই মানুষটি ঝুড়ি নামানো সন্ধ্যাবেলায় কোথায় চলে যাওয়া দিনগুলির সন্ধানেই খোলা আজান বাংলাদেশের জল মাটি আগুনের মঙ্গল সাধনায় নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছিলেন ।
রবীন্দ্রনাথে তাঁর ব্যাপ্তি, ছন্দে তাঁর গভীরতা, অমিয় চক্রবর্তী, ডঃ শহিদুল্লাহ, কামালউদ্দিন খানের পর ইকবাল চর্চার গহিনে তাঁর ডুব দেওয়া-এইসব কিছুকে অতিক্রম করে শঙ্খ ঘোষ চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবেন হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতি চর্চায় একজন আত্মনিবেদিত ব্যক্তিত্ব হিসেবে। শাশ্বত বঙ্গের সাধনায় ওদুদ-অন্নদাশঙ্কর-সুফিয়া কামালেরা যে ধারা সৃষ্টি করেছিলেন, এপার বাংলায় সেই ধারার প্রবাহমানতা বজায় রাখতে নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন শঙ্খ ঘোষ। ওদুদ, অন্নদাশঙ্কর যেভাবে কোনও দিন খন্ডিত বাংলা এবং বাঙালিকে মেনে নিতে পারেননি, শঙ্খবাবুও ঠিক সেই ভাবেই বাঙালির দেশ,ঘর, অন্তর ভাঙার ব্যথায় আকীর্ণ ছিলেন।
এপার বাংলার খুব কম মানুষই হিন্দু-মুসলমানের দ্বন্দ্বের মূল কারণ যে তত্ত্বের নয়,স্বত্ত্বের-সেটা অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন। এই বিরোধের কারণের যে স্বরূপ উদঘাটন করেছিলেন অন্নদাশঙ্কর, শঙ্খ ঘোষ ছিলেন সেই ভাবনারই পথিক। সুভাষচন্দ্রের সহোদর শরৎচন্দ্র বসু চারের দশকের শেষ প্রান্তে এসে আবুল হাশেমের সঙ্গে যুক্ত বাংলার কথা ভাবলেও এ কে ফজলুল হককে মধ্যরাতে যে ভাবে মাথাযন্ত্রণার অজুহাতে দেখা না করে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন শরৎ বাবু, আবুল মনসুর আহমদের সেই স্মৃতিচারণের ভিতরে উঠে এসেছে, বাংলার রাজনীতির ভাগ্যাকাশের এক বিয়োগান্তক অধ্যায়ের সূচনা বলেই বিশ্বাস ছিল শঙ্খবাবুর। তাই হারানো পাকশি, হারানো শৈশব, অখণ্ড বাঙালির ভাবাবেগ-যেন তপ্ত অঙ্গারের মতো ছিল শঙ্খবাবুর বুকের গোপন কুঠুরিতে।
প্রগতিশীল ভাবধারার মানুষ হয়েও শঙ্খ ঘোষ কখনও দলীয় রাজনীতির নিগড়ে নিজেকে সঁপে দেননি। একটা সময়ে অবিভক্ত কমিউনিষ্ট পার্টির সদস্যপদ নেওয়ার খানিকটা চাপ ছিল শঙ্খবাবুর উপর। আদর্শের প্রতি তাগিদ থাকলেও দলীয় আনুগত্যের শৃঙ্খলে নিজেকে শৃঙ্খলিত করা নিয়ে দ্বিধা ছিল শঙ্খের। সেই দ্বিধাকে অতিক্রম করতে তাঁকে সবথেকে বেশি সাহায্য করেছিলেন যিনি, তিনি নিজে কিন্তু ছিলেন কমিউনিষ্ট পার্টির সদস্য। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। কবি সুভাষের পরামর্শে শঙ্খবাবু শেষ পর্যন্ত কমিউনিষ্ট পার্টির সদস্য পদ গ্রহণ করেননি। এই সময়কালে কমিউনিষ্ট পার্টির ভিতরে যে মতাদর্শগত মৌলবাদী প্রবণতা তীব্র হয়েছিল, সেই সময়ের ভুক্তভোগী কলিম শরাফি যাকে বলতেন 'উনপঞ্চাশ বায়ু' সেই বি টি রণদিভের সাধারণ সম্পাদকের কাল নিঃসন্দেহে শঙ্খ ঘোষকেও অনেকখানি প্রভাবিত করেছিল। তাঁর যে ' ভিন্নরুচির অধিকারে-র প্রতি অন্তরের কাকুতি তার উদ্ভাষণ পর্ব, সেটিও তাই বিষ্ণু দে এবং 'সাহিত্যপত্র' অনেকখানিই জায়গা জুড়ে ছিল।
এই দিক থেকে বিচার করে বলতে হয়, গত শতাব্দীর দুইয়ের দশকে ঢাকা শহরকে কেন্দ্র করে যে' বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন' গড়ে ওঠে, অন্নদাশঙ্কর যাকে 'বাংলার দ্বিতীয় জাগরণ' বলে অভিহিত করেছিলেন, সেই ভাবধারা শঙ্খ ঘোষের ভিতরে খুব প্রবল ভাবেই সঞ্চারিত হয়েছিল। সীমাবদ্ধ জ্ঞানকে সম্বল করে কোনও যতি চিহ্ন টেনে দেওয়ার মতো মানুষ তিনি ছিলেন না। প্রায় এক দশক আগে পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়ন ঘিরে যখন বিতর্ক তুঙ্গে, নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর ক্রমশঃ উত্তপ্ত , সেই সময়কালে সিপিআই (এম) নেতা বিমান বসু গোটা বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে তাঁর কাছে গিয়েছিলেন। বিমান বাবু চলে যাওয়ার পর এই নিবন্ধকার কে শঙ্খবাবু বলেছিলেন; দেখলাম পয়তাল্লিশ মিনিট ধরে তিনি কেবল নিজের কথাই বলে গেলেন। বুঝলাম, দীর্ঘ চৌত্রিশ বছরে ওঁরা অন্যের কথা শোনার অভ্যাসটা হারিয়ে ফেলেছেন।
এটাই ছিলেন শঙ্খবাবু। বলতেন কম। শুনতেন বেশি। শুনেই চটজলদি মন্তব্য করতেন না। এই নীরবতা ঘিরে বিতর্ক ও কম হয়নি। জরুরি অবস্থার সময়ে তাঁর নীরবতা ঘিরে কবিতার ভাষাতেই তাঁকে বিদ্ধ করেছিলেন তাঁর বিশেষ বন্ধু গৌরকিশোর ঘোষ। বিদ্ধ হয়ে তৎক্ষণাৎ পাল্টা জবাব দেওয়া ছিল শঙ্খবাবুর স্বভাব বিরুদ্ধ। তাই গৌরকিশোরের সেই কবিতা ঘিরে কখনও প্রকাশ্যে একটি শব্দ ও শঙ্খ ঘোষ উচ্চারণ করেননি। একটা শানিত, ঋজু অথচ দৃঢ় অবস্থানের ভিতর দিয়ে এভাবেই গোটা জীবন এবং সৃষ্টিকে প্রবাহিত করে গেলেন শঙ্খ ঘোষ।
সমসাময়িকতার আবর্তন শঙ্খ ঘোষকে আবর্তিত করলেও সেই আবর্তনের মূর্ছনা শামসুর রাহমানের আঙ্গিকে শঙ্খবাবুকে কখনও আলোড়িত করেনি। দেশের চলায়মান ঘূর্ণাবর্তের সঙ্গে একজন সমাজ সংবদ্ধ স্রষ্টা নিজেকে সম্বৃক্ত করবেন কি, করবেন না- এটা সৃষ্টিশীলতার দুনিয়াতে একটি চিরকালীন প্রশ্ন। অন্নদাশঙ্কর সমকালীন ঘটনাপ্রবাহে খুব বেশি পথে নামেননি। কিন্তু সমকালীন রাজনীতিকে এড়িয়ে তিনি কখনও তাঁর সৃষ্টিকে পরিচালিত করেননি। সুভাষ মুখোপাধ্যায় তো সমকালীনতার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে নিজেকে বেঁধেছিলেন। এই সমকালীন সংযুক্তির কারণে পুরনো বন্ধুদের কাছে কম গঞ্জনা সহ্য করতে হয়নি কবি সুভাষকে। তাও সমকালীনতা থেকে পাশ কাটিয়ে, গা বাঁচিয়ে জীবন কাটাতে দেখা যায়নি সুভাষকে।
সুফিয়া কামালের সমাজ মনষ্কতা তাঁর সৃষ্টিশীল চরিত্রের সবথেকে বড় বৈশিষ্ট্য। সৃষ্টিশীলতাকে অক্ষুন্ন রেখে, ঘর সংসারকে বজায় রেখে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গের সমতার জন্যে কী ভাবে লড়তে হয় তা কেবল বাংলাদেশ বা বাঙালির কাছে নয়, গোটা মানবজাতির কাছে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গিয়েছেন সুফিয়া কামাল।
শঙ্খ ঘোষ কিন্তু এই ধারাপথের কোনওটারই পথিক ছিলেন না। জীবনের শেষ কুড়ি বছরে মানুষের অধিকার, দাঙ্গার বিরুদ্ধতা, মানবতার সঙ্কট, ইত্যাদি বিষয় ঘিরে তিনি অনবদ্য উচ্চারণ করেছেন। সেই উচ্চারণে কোচবিহারে পাঁচের দশকের খাদ্য আন্দোলনে 'যমুনাবতী' স্ফুরণ কতটা আমজনতার ভাষায় এসেছে আর কতটা শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মূর্ছনাতে প্রতিধ্বনিত হয়েছে- এ নিয়ে কবিতা প্রেমিকদের ভিতরেই বহু আলোচনা আছে। শঙ্খ প্রগলভ নন। কিন্তু সময়ের নিরিখে শঙ্খের উচ্চারণ কি অনেক বেশি সময়ব্যাপ্তিক? অনেক বেশি আলঙ্কারিক ? সত্যিই কিন্তু ধনুকে জ্যা রোপনে সুভাষ, শামসুরের মতো বেপরোয়া নয়? অনেক বেশি সাবধানী? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার সময় এখন নয়। এখন কেবল এটাই ভাববার বিষয় যে, অখন্ড বাঙালি জাতিসত্তার সম্যক বিকাশে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানের যে অবিমিশ্র অবদান, তা আজ ভয়াবহ সঙ্কটে। এই সঙ্কট থেকে উত্তীর্ণ হতে শঙ্খ ঘোষ বহুত্ববাদী জীবনদর্শন চর্চার যে প্রদীপটি জ্বালিয়ে গেলেন চিরজীবন ধরে, বাঙালির দহলিজকে আলোকিত করতে সেই প্রদীপকে অনির্বাণ করাই এখন একমাত্র মহৌষধ।